শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সরেজমিন বিএসএমএমইউ

লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতেই রোগীর দিন পার

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
প্রকাশিত: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৩:৩৫ পিএম

শেয়ার করুন:

লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতেই রোগীর দিন পার

চাঁদপুরের কচুয়া থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসককে দেখাতে এসেছেন সেলিনা আক্তার (৪৫)। বর্হিবিভাগ-১ এ ইউরোলজি বিভাগের চিকিৎসককে তার সমস্যার কথা জানানোর পর তাকে কিছু পরীক্ষা দিয়ে, রিপোর্টসহ দেখা করতে বললেন। এরপর একই ভবনের প্যাথলজি বিভাগে (বর্হিবিভাগ-১) গ্রাউন্ড ফ্লোরে পরীক্ষার রিসিট কাটতে (টাকা জমা দেওয়ার) লাইনে দাঁড়ান। এক ঘণ্টা ৩৫ মিনিট পর কাউন্টারে কর্তব্যরত স্টাফ জানালেন, আজ হবে না। সকালে খালি পেটে আসতে হবে।

এসময় এ রোগীকে কাউন্টারে থাকা হাসপাতালের স্টাফের সাথে তর্কে জড়াতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওই রোগী প্রতিবেদককে জানান, সকালে বাস যোগে ঢাকায় এসেছি। এসে হাসপাতালের বাহিরে লাইনে দাঁড়াই। কাউন্টার খোলার পর টিকিটে কাটছি। চিকিৎসকের রুমের সামনেও ছিল লম্বা লাইন। সবশেষ পরীক্ষার রিসিট কাটতে এসে বলছে- আজ হবে না। অথচ পরীক্ষা করাবো বলে সকাল থেকে না খেয়েই আছি। কারণ এখন প্রায় দুপুর। এটা কি সম্ভব বলেন? লাইল ধরতে ধরতেই তো জানে পানি নাই। রাতে থাকব কই? ফের কাল আসা কি সম্ভব?


বিজ্ঞাপন


শুধু সেলিনা আক্তারই নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) বর্হিবিভাগে সেবা নিতে আসা প্রায় সব রোগীদের একই অভিযোগ। তারা বলছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পরীক্ষার রিসিট কাটার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে চিকিৎসককে দেখানো গেলেও একই দিনে পরীক্ষা করানো যায় না। এতে করে বারংবার আসা যাওয়ার ভোগান্তির পাশাপাশি দূর থেকে আসা রোগীদের বাধ্য হয়ে বাহিরে পরীক্ষা করাতে হয়।

অন্যদিকে সচেতন রোগীরা বলছেন, হাসপাতালটিতে সেই মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিতেই চলছে রিসিট কাটাসহ ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া। সেবা প্রাপ্তিতে আরও সহজ করার দাবি তাদের।

সরেজমিনেও মিলেছে এর সত্যতা। ঘুরে দেখা যায়, দীর্ঘ সিরিয়ালে পড়তে হয় পরীক্ষার রিসিট কাটতে গেলে। দায়িত্বরত স্টাফের একাধিক রিসিট কাটতে জনপ্রতি সময় লেগে যায় ৩-৫ মিনিট। তারপর আছে ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার সিরিয়াল। আছে স্যাম্পল জমা দেওয়ার সিরিয়াল। সবশেষ রিপোর্ট নেওয়ার দীর্ঘ সিরিয়াল।

19


বিজ্ঞাপন


এবার আসা যাক আরেকটি ঘটনায়। হাপাতালটির ২নং ভবনের ডে কেয়ার ওটিতে অপারেশন পরবর্তী ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছেন নজরুল ইসলাম। তার বাবা ইসমাইল হোসেনের (৮৪) অপারেশন হয়েছে। যেখানে তাকে পোহাতে হয়েছে ভোগান্তি। প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি জানান, ওটি থেকে অপারেশনের পর বলা হলো এফ ব্লকে গিয়ে টাকার রিসিট কেটে নিতে। দীর্ঘক্ষণ খোঁজাখুজি করে একজন আনসার সদস্যর সাহায্য নিয়ে একটা রুমে যাই। গিয়ে দেখি কেউই নাই। আমার মতো আরও ১ জন অপেক্ষা করছেন। অন্তত ২০ মিনিট পর একজন আসলেন।

নজরুল ইসলাম বলেন, চারটি পেমেন্ট স্লিপ প্রিন্ট করে তারা একটি রেখে দেয়। বাকি তিনটি দিয়ে বলে একই ভবনের নিচ তলায় ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে ফের আসতে হবে। নিচে গিয়ে দেখি ব্যাংক বন্ধ হয়ে দেছে। ছুটে যাই বর্হিবিভাগের গ্রাউন্ড প্লোরের ব্যাংকে। টাকা জমা দিয়ে আবারও এফ ব্লকে আগের ঠিকানায় আসি। সেখানে গিয়ে আবারও দেখি রুমে কেউ নেই। কিছুক্ষণ পর এক ব্যক্তি এসে ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার রশিদে ‘পেইড’ সিল দিয়ে দেয়। অথচ এসব কাজ একবারেই হয় অন্য হাসপাতালগুলোতে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে দেশের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে এসব জটিলতা সমাধানে আধুনিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাখালীতে আইসিডিডিআরবি কিংবা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। যেখানে প্রতিদিন রোগীর আলাদা কিউআর কোড কিংবা নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন নম্বরের আওতায় সেবা মিলে। ঘুরতে হয় না একটির পর একটি কাউন্টার। অন্যদিকে দেশের অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল রোগীর পরীক্ষা পরবর্তী পরীক্ষার রিপোর্ট অনলাইনে পাঠানোর ব্যবস্থা রয়েছে। যদিও বিএসএমএমইউ’তে এখনও তার ছোঁয়া লাগেনি। তবে দীর্ঘদিন ধরে এসব আধুনিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার হচ্ছে কিংবা হবে বলে জানিয়েছে আসছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

যা করা গেলে সেবা নিতে আসা রোগীদের ভোগান্তি অনেকাশেই কমে যেত। সেই সাথে অনলাইন ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নসহ রিপোর্ট প্রাপ্তিতে (হোয়াটসআপ, মেইল) সহজ করার কথা বলছেন সেবা গ্রহীতারা। যা করা গেলে অধিক সংখ্যক স্টাফেরও প্রয়োজন হতো না বলছেন তারা।

বর্হিবিভাগের ২নং ভবনের নিচ তলায় রিপোর্ট নিতে কুমিল্লা থেকে এসেছেন কুলসুম বেগম। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়েও পাননি। এসময় তার মতো স্থানটিতে অন্তত তিন শতাধিক ব্যক্তিকে পাঁচটি লাইনে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট সংগ্রহ করতে দেখা যায়। রিপোর্ট না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে কুলসুম বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন, বলেছে এখনও আসেনি। কিন্তু আজ রিপোর্ট দেওয়ার কথা। বর্হিবিভাগের-১ এর নিচ তলায় খোঁজ নিতে বলেছেন।

কুলসুম বেগম বলেন, আশা ছিল সকাল সকাল রিপোর্টটা নিয়ে ডাক্তারকে দেখাতে পারব। এখন প্রায় দুপুর হয়ে আসছে। কখন পাবো আর কখন ডাক্তার দেখাবো জানি না।

তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে তারা পোস্টার ব্যানার করে রাখছে, প্রচার করছে যে- রিপোর্ট মেইলে অনলাইনে পাঠিয়ে দেবে। বাস্তবে এমন কোনো ব্যবস্থাই নেই। দিলে আমরা দোকান থেকে প্রিন্ট করে নিতাম। শুধু রিপোর্টের জন্য কতো মানুষ দূর দূরান্ত থেকে আসে। এলাকার ডায়াগনস্টিকগুলোও এখন মেইলে রিপোর্ট দেয়, এরা দেয় না।

18

অনলাইনে চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে এসেছেন ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী ফয়সাল খাঁন। বহির্বিভাগের নিচ তলায় লাইনে দাঁড়িয়ে জানতে পারেন এর টিকিট মিলবে ৩য় তলায়। সেখানে গিয়ে দেখেন নারী-পুরুষ মিলিয়ে অন্তত ২শ জন লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। সিরিয়াল ধরে একপর্যায়ে টিকিট পান তিনি।

ঢাকা মেইলের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, বলা হচ্ছে অনলাইন বাস্তবে অনলাইনের সাথে বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। টাকা দিয়েছি টিকিট দিয়েছে। পার্থক্য ফোনে একটা এসএমএস। যেখানে সময় দিয়ে দেওয়া আছে, তবে লাইনে দাঁড়িয়ে সে সময় এতোক্ষণে পার হয়ে গেছে। উপরে ডাক্তার রুমের সামেনেও সিরিয়ালে দাঁড়াতে হবে। তাহলে সময়ের কি মূল্য রইল?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) বর্হিবিভাগ-১ কর্মরত সমাজসেবা অফিসার মেহেদী হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, অনলাইনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট প্রাপ্তির একটা বিষয় আলোচলা চলছিল। জানা মতে এখনও শুরু হয়নি। ডাক্তারের সিরিয়াল নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনলাইনে করা যায়। তবে পরবর্তীতে স্বশরীরে এসে টাকা দিয়ে এসএমএস দেখিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়।

সার্বিক বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রেজাউর রহমানের সাথে দীর্ঘ অপেক্ষার পর তার কার্যালয়ে কথা বলেন প্রতিবেদক।

রোগীদের দুর্ভোগ ও অনলাইন সেবা পুরোপুরি চালু করা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘এ নিয়ে আমার মন্তব্য করার অনুমতি নেই।’ পরে তিনি হাসপাতালের মিডিয়া সেলের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

পরে বিএসএমএমইউর জনসংযোগ কর্মকর্তা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তা (অতি. দা.) প্রশান্ত কুমার মজুমদারের কাছে গেলে তিনি এ বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করার কোনো গুরুত্ব নেই বলে মন্তব্য করেন।

সবশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মিডিয়া সেল প্রধান সমন্বয়ক ডা. এসএম ইয়ার ই মাহবুবের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

ডিএইচডি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর