শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

তিন চামড়ার দামেও মেলে না একজোড়া জুতা!

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ১৬ জুলাই ২০২২, ০৯:৩০ পিএম

শেয়ার করুন:

তিন চামড়ার দামেও মেলে না একজোড়া জুতা!

বাজারে সবকিছুর দাম যখন ঊর্ধ্বমুখী তখন কমছে শুধু কাঁচা চামড়ার দাম। ২০১৩-২০১৪ সালের দিকেও মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার গরুর একটিমাত্র চামড়া বিক্রি হতো এক থেকে দেড় হাজার টাকায়। সে সময় বড় গরুর চামড়া ধরনভেদে দুই থেকে তিন হাজার টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। ফলে ওই সময়ে কোরবানি ঈদের দিন পাড়া-মহল্লায় গিয়ে ব্যবসায়ীদের চামড়া সংগ্রহ করতেও দেখা গেছে। আবার কিছু কিছু পাইকাররা আগেথেকেই যারা কোরবানি দিত তাদের সঙ্গে কথা বলে রাখত। সঙ্গে কিছু টাকা বায়নাও দিয়ে দিত।

ওই সময়ে ৫০০ থেকে হাজার টাকার মধ্যে ভালো মান ও ডিজাইনের মিড রেঞ্জের একজোড়া চামড়ার জুতা পাওয়া যেত। তবে শুধু জুতাই নয়, সকল চামড়া পণের দামও সে সময় ছিল নাগালের মধ্যেই। কিন্তু এখন লাখ টাকা দামের গরুর চামড়াও বিক্রি হচ্ছে মাত্র চার থেকে ছয়শত টাকায়। যেখানে বর্তমানে জুতার শো-রুমে গেলে দুই হাজার টাকার নিচে মেলে না ভালো কোনো চামড়ার জুতা। আর একটু ভালো ব্র্যান্ডের দোকানে গেলে তো কথাই নেই!


বিজ্ঞাপন


এক জোড়া জুতা তৈরিতে কতটুকু চামড়া প্রয়োজন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এই হিসেবে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির এই সময়ে তিন থেকে চারটি চামড়ার দামেও একজোড়া জুতা মিলছে না। বর্তমানে শুধু চামড়ার জুতাই নয়, চামড়া দিয়ে তৈরি সকল পণ্যের দামও বেড়েছে। একটি মোটামুটি চামড়ার মানিব্যাগ/ওয়ালেটের দাম এখন ৫০০ টাকা। তবে মানভেদে বিভিন্ন ব্রান্ডের ওয়ালেট কয়েক হাজার টাকাতেও বিক্রি হয়। পাশাপাশি চামড়ার তৈরি কোমড়ের বেল্টের দামও হাজার ছুঁইছুঁই। আর চামড়ার তৈরি একটি ভ্যানিটি ব্যাগের দাম রীতিমতো বেড়ে হয়েছে কয়েক হাজার টাকা।

Qurbani Special

রাজধানীর বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শো-রুম ঘুরে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। শো-রুমগুলোর ডিসপ্লেতে রাখা চামড়ার স্যু’র সর্বনিম্ন মূল্য লেখা রয়েছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। যদিও বিক্রেতাদের দাবি- কয়েক বছর আগেও এই ধরনের জুতা তারা এক হাজার থেকে ১৫০০শ’ টাকায় বিক্রি করেছেন। তবে এখন সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় চড়া দামেই জুতা বিক্রি হচ্ছে।

শুধু শো-রুমেই নয়, নানা অনলাইন মার্কেটে সার্চ করেও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চামড়ার জুতার দাম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুই হাজার টাকার ওপরে দেখা গেছে।


বিজ্ঞাপন


রাজধানীর মৌচাক এলাকায় একটি ব্র্যান্ড শো-রুমে জুতা কিনতে আসা আনিস একজোড়া স্যু দেখিয়ে বলেন, কয়েক বছর আগে এই ধরনের জুতা আমরা ৮০০ থেকে হাজার টাকায় কিনতাম। অথচ এটাই এখন দুই হাজার টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। আবার কোরবানির সময় চামড়ার দাম নেই।

আনিস ছাড়াও বেশ কয়েকজন ক্রেতা জুতা কিনতে এসে একই কথা জানিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

Qurbani Special

চামড়ার দাম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকেই ক্ষোভ ঝাড়ছেন। মনসুরুল আলম মনসুর নামে একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন- ‘কয়েকদিন আগে যমুনা ফিউচার পার্কে মানিব্যাগ কিনতে গিয়েছিলাম। দোকানদার একটি চামড়ার মানিব্যাগ দেখালেন। দাম মাত্র পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা! দোকানদার বললেন, আগুন জ্বালিয়ে চেক করে নিতে পারেন। আমাদের দোকানে কোনো ভেজাল জিনিস নাই। এগুলো একদম অরিজিনাল চামড়া।’

মনসুরুল আলম মনসুর আরও লিখেছেন- ‘সেই অরিজিনাল চামড়ার মানিব্যাগে চামড়ার পরিমাণ কতটুকু হতে পারে? সর্বোচ্চ দুই বর্গফুট বা একটু কম-বেশি। অথচ দাম পাঁচ হাজার টাকা। জুতার শো-রুমে গেলেও চামড়ার দাম দেখা যায়। একজোড়া সাধারণ জুতার দাম তিন-পাঁচ হাজার টাকা। মজার ব্যাপার হলো- শুধুমাত্র কোরবানির সময় আসলে বাংলাদেশে চামড়ার দাম কমে যায়! ৮০/৯০ হাজার টাকা দামের গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় মাত্র ১৫০/২০০ টাকা।’

ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে মনসুর আরও লিখেছেন- ‘কোরবানির পশুর চামড়া গরিব-মিসকিনের হক। আবহমান কাল থেকে কোরবানির চামড়া লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানায় দিয়ে আসছেন কোরবানি দাতারা। গত কয়েক বছর থেকে শকুনদের নজর পড়েছে গরিব-মিসকিনের হকে। তারা সিন্ডিকেট করে কোরবানির চামড়ার দাম কমিয়ে নিজেদের পেট ভরছে।’

চলতি বছর সরকারি নির্ধারিত দামের থেকেও কম দামে চামড়া কিনছে ব্যবসায়ীরা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে ৫২ টাকা নির্ধারণ করেছিল। আর ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। এছাড়া খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ঢাকায় ১৮ থেকে ২০ টাকা, বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পাশাপাশি ঢাকার বাইরে ও ঢাকায় বকরি এবং খাসির চামড়ার দাম একই রাখা হয়েছিল। যদিও গতবারের তুলনায় চলতি বছর প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৭ টাকা এবং খাসির চামড়ায় ৩ টাকা বাড়তি দাম নির্ধারণ করেছিল মন্ত্রণালয়।

Qurbani Special

তবে ঈদের দিন দুপুরের পর পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তায় ছোট আকারের গরুর চামড়া ২০০-২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া মাঝারি আকারের গরুর চামড়া মানভেদে ৩০০-৭৫০ টাকা এবং বড় আকারের গরুর চামড়া ৮০০-১১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যদিও অধিকাংশ আড়তদার ছোট আকারের গরুর চামড়া এবং খাসি ও বকরির চামড়া কিনতে অনীহা দেখান। আর ছোট আকারের গরুর চামড়া কেউ বিক্রি করতে আনলে ন্যূনতম ১০০ টাকা দামও বলেছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া খাসি ও বকরির চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ১০ টাকায়।

অথচ, ২০১৪ সালে সরকার ও ব্যবসায়ীরা চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল তার থেকেও বেশি দামে সে বছর চামড়া বিক্রি হয়েছিল। ওই বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ ছিল ৭০-৭৫ টাকা। আর ঢাকার বাইরে দর ছিল ৬০-৬৫ টাকা। তবে শেষ পর্যন্ত কোরবানির ঈদের দিন পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তায় লবণবিহীন প্রতি বর্গফুট চামড়াই বিক্রি হয় ৯০-১০০ টাকায়।

ঢাকায় ছয় বছরের কোরবানির গরুর চামড়ার দাম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৩ সালে প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। পরের বছর ২০১৪ সালে ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, ২০১৫ সালে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, ২০১৬ সালে ৫০ টাকা, ২০১৭ সালে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং ২০১৮ সালে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে এই দাম প্রতি বর্গফুটে আরও পাঁচ টাকা কম। এই হিসাবে ২০১৩ থেকে ২০১৮ ছয় বছরে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কমেছে ৪৫ শতাংশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সাল থেকে কাঁচা চামড়ার দামে ধস নামতে শুরু করে। তার আগে প্রতিটি গরুর চামড়া সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন অনেকে। কিন্তু গেল সাত বছর থেকে আর কোনো দাম মিলছে না। প্রতিবছর সরকার দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু সরকারের নির্ধারিত দামকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সিন্ডিকেট করে মধ্যস্বত্বভোগী ও ট্যানারি মালিকরা লাভবান হচ্ছেন। বিশেষ করে বিভিন্ন মসজিদ-মাদরাসা থেকে সংগৃহীত চামড়া বিক্রি করতে গিয়ে কোনো দাম পাওয়া যাচ্ছে না।

ঈদের পরদিন ঢাকার ফরিদাবাদ মাদরাসায় সংগৃহীত গরুর চামড়া বিক্রি করা হয়েছে সাড়ে ৭০০ টাকা দরে এবং ছাগলের চামড়া ১৫ টাকা ফুট। কিন্তু ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রি করার ফলে এই টাকা তারা এখনও হাতে পাননি। তাতে চামড়াগুলো মাদরাসা থেকে বিক্রি করার সময়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তেমন কোনো দাম বলেনি।

Qurbani Special

ঢাকায় দুই হাজারের বেশি মাদরাসা রয়েছে। এসব মাদরাসা থেকে প্রতিবছর চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এবার গড়ে প্রতিটি মাদরাসায় ৫০০-৭০০টি করে গরু চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে হিসাব করলে প্রায় ১১ লাখের ওপরে শুধু চামড়া কালেকশন হয়েছে। এসব মাদরাসার বিভিন্ন সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা কেউই বাজার দর অনুযায়ী দাম পাননি। ঢাকায় দুই হাজারের বেশি মাদরাসা থাকলেও হাতে গোনা কয়েকটি মাদরাসা সরাসরি ট্যানারি মালিকদের হাতে চামড়া তুলে দেন। তারাও বাজার মূল্য সঠিকভাবে পান না বলে অভিযোগও রয়েছে।

রাজধানীর বেশ কয়েকটি মাদরাসা ঘুরে জানা গেছে, এবার তাদের পক্ষ থেকে গরু ও ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল। ভালো দামের আশায় ঈদের পরদিন সেগুলো সাভারের একটি ট্যানারিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে গরুর চামড়াগুলো মোট মূল্যের অর্ধেক দাম পেলেও ছাগলের প্রায় দুই থেকে আড়াইশ’ চামড়া ফেলে দিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন তারা। আর গরুর মাথার চামড়া কোনোভাবেই এবার বিক্রি করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন অধিকাংশ মাদরাসার চামড়া সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা।

এ বিষয়ে ফরিদাবাদ মাদরাসার এক শিক্ষক ঢাকা মেইলকে জানান, গত বছর তারা গরুর চামড়া মাত্র ১০০ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি করেছেন। আর ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। তবে এবার গরুর চামড়ায় তারা কিছুটা দাম পাবেন বলে আশা করছেন। কারণ, তাদের সংগৃহীত চামড়াগুলো একজন ট্যানারি মালিককে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই মালিকের পক্ষ থেকে এখনও কিছু বলা হয়নি, প্রতিটি গরুর চামড়া তিনি কত টাকা করে তাদের দেবেন।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানারি মালিক সমিতির নেতা শাহিন আহমেদসহ লেদার গুডস অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাদের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে গত বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) রাজধানীর ধানমন্ডি ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে শাহিন আহমেদ বলেন, এ বছরের ঈদুল আজহায় কোরবানি হওয়া পশুর মধ্যে ৯৫ লাখ চাড়া সংগ্রহ হয়েছে। মঙ্গলবার (১২ জুলাই) পর্যন্ত সাভারে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ পিস পশুর চামড়া পৌঁছেছে। সেগুলোতে লবণ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ ছাগলের চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। আগামী চার থেকে পাঁচদিন পর লবণযুক্ত চামড়া সরকার নির্ধারিত দামেই তারা কিনবেন।

টিএই/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর